Golden Bangladesh
Eminent People - জিয়া হায়দার

Pictureজিয়া হায়দার
Nameজিয়া হায়দার
DistrictPabna
ThanaNot set
Address
Phone
Mobile
Email
Website
Eminent Typeচলচিত্র ও নাটক
Life Style

জিয়া হায়দার যখন কলেজে পড়তেন তখন তাঁর বাবাহাকিমউদ্দিন শেখ বেঁকে বসলেনছেলেকে আর পড়াবেন না। তিনি তাঁকে বললেন 'বাড়িফিরে আস। জমি-জিরাত দেখাশোনাকর, ব্যবসা-বাণিজ্য কর। আর লেখাপড়া করতে হবে না।' জিয়া হায়দারের মনটা ভেঙ্গেগেল। কারণ তিনি এই হায়দার বংশের প্রথমমেট্রিকুলেট। কত স্বপ্ন তাঁর। তিনি নিজেপড়াশুনা করবেন। ভাই-বোনদের পড়াশোনা করাবেন। কিন্তুবাবার এই সিদ্ধান্তে আকাশভেঙ্গে পড়ল তাঁর মাথায়। আর ঠিক এই সময়ই এগিয়েএলেন তাঁর মা রহিমা খাতুন।

স্বামীর অজান্তে নিজের গলার দামি একখানা হারবিক্রি করে ছেলেকে দিলেন পড়াশুনাকরার জন্য। এ নিয়ে পরে স্বামীর অনেক গালমন্দও শুনতেহয়েছে তাঁকে। মায়ের দেয়াহার বিক্রির টাকায় নতুন উদ্যোমে পড়াশুনা শুরু করলেনতিনি। মায়ের দেয়া হারবিক্রির সেই টাকা বৃথা যেতে দেননি জিয়া হায়দারকারণ তিনি এদেশের খ্যাতনামানাট্য ব্যক্তিত্ব, কবি এবং শিক্ষক জিয়া হায়দার নামেপরিচিতি লাভ করেন।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জিয়াহায়দার বাংলাদেশেরনাট্যকলাকে সৃজনশীলতা, প্রজ্ঞা ও সাধনায় সমৃদ্ধ করতেআমৃত্যু প্রয়াসী ছিলেন। পাঁচখণ্ডে লিখেছেন থিয়েটারের কথা। নাটককেপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করারক্ষেত্রে রেখেছেন বিশেষ অবদান।

জিয়া হায়দারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর পাবনাজেলার দোহারপাড়া গ্রামে।পারিবারিকভাবে জিয়া হায়দারদের পরিবার ছিল বিশালভূ-সম্পদের অধিকারী। তাঁরবাবা সেই জমি-জমা দেখতেন। আর ঠিকাদারি ব্যবসাকরতেন। মূলত পরিবারটি ছিলসামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার। তাঁর মা ছিলেন গৃহিণী।মাত্র ক্লাস থ্রি পর্যন্তপড়াশোনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিদ্যা নিয়েইতিনি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি', এমনকি 'গোরা'র মতো কঠিন উপন্যাসওবানান করে করে পড়েফেলেছিলেন। হায়দার পরিবারের ছেলেদের কপালে 'সাহিত্যিক' অভিধা জোটার পেছনেএই মাতৃদেবীর ভূমিকা ছিল অনেকখানি। হাকিমউদ্দিনশেখ আর রহিমা খাতুনের পাঁচছেলে ও তিন মেয়ে। জিয়া হায়দার সর্ব জ্যেষ্ঠ। ডাকনাম রউফ। বাড়ির ছোটরা তাঁকেআদর করে 'সোনাভাই' বলে ডাকতেন।

সেকালে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে সন্তান হলে তাঁরকুষ্টি লিখে রাখা হত। কুষ্টিমানে যাতে সন্তানের ভূত-ভবিষ্যত লেখা থাকে। জন্মেরক্ষণের সাথে মিলিয়ে পণ্ডিতবা আলেমরা এই কুষ্টি লিখে দিতেন। কুষ্টির কথাকতটুকু ফলত তা নিয়ে মনে হয়লোকে খুব একটা মাথা ঘামাত না। একটা গোল করেগোঁটানো লম্বা কাগজে বাঁকা-বাঁকাপ্রাচীন ধাঁচের হাতের লেখায় কী সব হাবিজাবি লেখাহত এবং সেটি বাড়ির দেয়ালেরগায়ে লাগানো কাঠের তাকে যত্ন করে তুলে রাখা হত, আর এটিই হল সেই কুষ্টি।নাট্যজন জিয়া হায়দারের এরকম একটা কুষ্টি ছিল।তাতে কী লেখা ছিল তা জানাযায়নি।

জিয়া হায়দারের লেখাপড়ার শুরু তাঁর বাবারই প্রতিষ্ঠিতএকটি প্রাথমিক স্কুলে। নামআরিফপুর প্রাথমিক স্কুল। এখানে ক্লাস টু পর্যন্তপড়াশোনা করেন তিনি। পরে চলে যানপাবনা জেলা স্কুলে। সেখানে গিয়ে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তিহন। এরপর গোপালচন্দ্রইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেনজিয়া হায়দার।

একই বছর ভর্তি হন পাবনা এডওর্য়াড কলেজে।কলেজেভর্তি হয়েই জড়িয়ে পড়েন ছাত্রআন্দোলনের সাথে। আগে থেকেই চেনাজানা ছিলরাজনৈতিক পরিমণ্ডলের লোকজনদেরসাথে। নিজে যেহেতু গল্প-কবিতা লিখতেন, শহরেশিক্ষিত সমাজে তাঁর একটা পরিচিতিছিল। ফলে পাকিস্তানি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করারজাতীয়তাবাদী আন্দোলনেএকেবারে যুক্ত হয়ে গেলেন তিনি। এমনভাবেই মিশলেনযে কলেজ জীবনের তিনটি বছরমাটি করে দিলেন। অবশ্য এক বছর শারীরিক অসুস্থতায়ওভুগেছেন। তবে এর জন্যরাজনীতিই একমাত্র কারণ না। সাহিত্যও বোধ হয়আরেকটা কারণ। জিয়া হায়দার তোতখন কবিতার খেচর।

পাবনা তখন শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সমঝদার শহর। এছোট জেলা শহরটি তখনসাহিত্যের প্রতি খুবই আগ্রহী। উৎসাহী কিছু তরুণকবিতাকর্মী ছিল এর নেপথ্যে। জিয়াহায়দার ভিড়ে গেলেন সেই দলে। তাঁর লেখা তখন ঢাকাথেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায়হরহামেশাই ছাপা হচ্ছে। বাড়িতে গেলে নিজের ভাইদেরএসব কবিতা পড়ে পড়ে শোনান।ছাপা অক্ষরে সোনাভাইয়ের নাম। ভাইদের বিস্ময় জাগেমনে। গর্ব হয় সোনাভাইয়েরজন্য।

এভাবে তিন বছর নষ্ট হওয়ায় বাবা হাকিমউদ্দিন শেখবেঁকে বসলেন ছেলেকে আরপড়াবেন না। অবশেষে মা রহিমা খাতুনের হস্তক্ষেপেতিনি পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকেইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর জিয়াহায়দার ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে তিনিসেখান থেকে বাংলায় অনার্সডিগ্রি লাভ করেন। রাজশাহী অবস্থানকালে তিনিসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে বেশভালভাবেই জড়িয়ে যান। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানেরউত্তাল-অস্থির রাজনীতি। দেশহাঁটছে স্বাধীনতার পথে, ধীরে ধীরে। জিয়া হায়দারমাঝে মাঝেই যান রাজশাহীবিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন সত্যিকারঅর্থেই সাহিত্যের তীর্থভূমি।কবি ও সাহিত্যিক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফানুরউল ইসলাম, কবি মযহারুলইসলাম, অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক বদরুদ্দীনউমর, অধ্যাপক মশাররফ হোসেন, হাসান আজিজুল হক, আবদুল হাফিজ, আলী আনোয়ার সবাইমিলে যেন এক শিল্প-সাহিত্যেররাজত্ব তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকেই তখনছোট কাগজ সম্পাদনা করেন।গল্প-কবিতা লেখার কারণে সকলেরই খুব ঘনিষ্ঠ হয়েওঠেন জিয়া হায়দার। এমনপরিবেশে নিজেকে নিয়োজিত করে রাখেন কবিতালেখায়। ঢাকার অনেক পত্রিকাতেইতখন নিয়মিত কবিতা ছাপা হচ্ছে তাঁর। সারাদিনঘোরাঘুরি, রাতভর আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক, শেষ রাতে আস্তানায় ফেরা। সব কিছুতেইনিজেকে লীন করে দেন। আবারগোপনে বুনে তোলেন সাহিত্যের নিজস্ব এক ঠিকানাও।

এরপর মাস্টার্স ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং১৯৬১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রিসম্পন্ন করেন। তারপর কিছুদিন কাজ করেন তখনকারজনপ্রিয় সাপ্তাহিক 'চিত্রালি'-তে।মাস্টার্সের ফল বেরুবার আগেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়েচলে যান তোলারাম কলেজে।যাবার সময় নিজের চাকরিটা দিয়ে যান ছোট ভাই রশীদহায়দারকে। নিজেরলেখালেখির জগত, চাকরি আর পরিবারের ছোটভাই-বোনদের মানুষ করার জন্য চেষ্টাকরতে থাকেন। এর মাঝে কিছুদিন কাজ করেন বাংলাএকাডেমিতে। তারপরে পাকিস্তানটেলিভিশনে। টেলিভিশন ভবন তখন ছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৮সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরহাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকবিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরে ইংল্যান্ডেরবার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার' ডিগ্রি অর্জনকরেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া হায়দার যোগ দেনচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরনাট্যকলা বিভাগে। সেখান থেকেই অবসর নেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় এবংপরে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা পৃথিবী চষেবেরিয়েছেন নাটকের প্রয়োজনে।বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের নামি-দামি নাট্যজনদেরসাথে।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যআজিজুর রহমান মল্লিকের পরামর্শে তখন চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একজরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছিল 'কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এ্যান্ডইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ' নামে এক কেন্দ্র। সেখানেরল্যাবরেটরিতে হাত বোমা, গ্রেনেড তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হয়। ২৩ মার্চ চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকও সাধারণ জনতার প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভাঅনুষ্ঠিত হয়। জিয়া হায়দারওসেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সভাতেই সভাপতিজনতার ইচ্ছায় বাংলাদেশের জাতীয়পতাকা উত্তোলন করেন। সভা থেকে এক বিরাট মিছিলচট্টলার রাজপথ অতিক্রম করে।সেই সভা চলাকালেই চট্টগ্রাম বন্দরে 'সোয়াত' জাহাজথেকে অস্ত্র নামানোর সময়বাঙালি জনতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ারখবর আসে।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহবাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে।সেসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সবাইএকযোগে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়েপড়ে। ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্যাম্পাসছেড়ে দেয়। চট্টগ্রাম শহরের তখনপতন হয়ে গেছে। জিয়া হায়দার ফিরে আসেন ঢাকায়।ঢাকা তখন অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধঢাকাতেই হায়দার পরিবারের ছেলেরা মুক্তিযোদ্ধাদেরসহযোগিতার জন্য জীবনের ঝুঁকিনিয়ে কাজ করেন। রশীদ হায়দার তখন খিলগাঁওয়ে একটিভাড়া বাসায় থাকতেন।সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু কাজ হত। যদিও ছোটভাই জাহিদ হায়দার সরাসরিযুদ্ধ করার জন্য ভারত গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি পরেআবার ফিরে আসেন।

১৯৬৪ সালে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে তিনি মা আর ছোটভাই-বোনদের নিয়ে আসেন ।কারণ হায়দার পরিবারে যতটা বিত্ত ছিল, ততটা বিদ্যাছিল না। তাই তাঁর ইচ্ছেসবাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। আজ যারাহায়দার পরিবারকে জানেন, চিনেন তাঁরা একথা মানবেন যে এর মূল কাণ্ডারি ছিলেনজিয়া হায়দারমানুষটি একেরপর এক নিজের পরিবার, নাটক, বিশ্ববিদ্যালয়, দেশনিয়ে গুছিয়ে কাজ করে গেছেন।সেসব ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। কিন্তু জিয়া হায়দারেরনিজের জীবনটা ততোটাগোছানো ছিল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি মেয়েকেভালবাসতেন। সবাই জানত তাঁদের বিয়েহবে কিন্তু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেলেন, সেখানেএক সহপাঠীর সাথে জড়িয়ে পড়েনআবেগময় সম্পর্কে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই 'মেম'-এর সাথে যোগাযোগ ওগভীর টান থাকলেও এক ছাদের নীচে বাস করা হয়নিতাঁদের। মা, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবার অনুরোধে-উপরোধে শেষ পর্যন্ত বিয়েকরেন এক অধ্যাপিকাকে, ১৯৭৫সালের ২৩ জুন। অধ্যাপিকা ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন।কিন্তু সে বিয়েও টেকেনি।কারণ অধ্যাপিকা ছিলেন সিজনাল মানসিক রোগী। সেটাবিয়ের পর ধরা পরে। কিন্তুকিছুই করার ছিল না জিয়া হায়দারের। চিকিৎসার সবরকম চেষ্টাই করেন তিনি।অবশেষে সেই সংসারও ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে বিয়েরসেই তারিখ আর নিজের বিড়ম্বিতভাগ্য নিয়ে রসিকতা করে বলতেন, '১৭৫৭ সালের ২৩ জুননবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যেবিপর্যয় নেমে এসেছিল।'

এই বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়েই সারাটা জীবন চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আরসেখানকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়েকাটিয়ে দিলেন জিয়াহায়দার। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া ঢাকায় আসতেনও না।দূর থেকে আত্মীয়-স্বজনদেরসহযোগিতা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করতেন। চট্টগ্রামেরব্যস্ততম এলাকারলালখানবাজার মোড়ের ইস্পাহানি বিল্ডিংয়ে শুধু রাশিরাশি বই আর তার ব্যক্তিগতঅজস্র অসংখ্য স্মৃতিভার অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলেনজিয়া হায়দার। এটা সন্ন্যাস নয়।নয় বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগও। কিন্তু নিঃসঙ্গ। বিপুল একশূন্যতা নিয়েই সমস্ত জীবনকেটেছে তাঁর।

এই অবস্থাতেই শেষ জীবনে এসে আক্রান্ত হলেনমরণব্যাধি ক্যান্সারে। অনেক কাজে হাতদিয়েছিলেন। আর কিছুটা সময়ও প্রয়োজন ছিল জিয়াহায়দারের। অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্নকরার জন্য, খুব বাঁচার আকুতি ছিল তাঁর। ভাইদের বলতেনসেকথা। কিন্তু ডাক্তার তো সবজানেন, তারা খুব অল্প সময়ই বেঁধে দিয়েছিলেনপরিবারের সদস্যদের। ২০০৮ সালের ২সেপ্টেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন জিয়াহায়দার। তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িতকরা হয় জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়ার আরিফপুরগোরস্থানে।

জিয়া হায়দারের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যেরয়েছে-একতারাতে কান্না (১৯৬৩), কৌটার ইচ্ছেগুলো (১৯৬৪), দূর থেকে দেখা (১৯৭৭), আমার পলাতক ছায়া (১৯৮২), লোকটি ও তার পেছনের মানুষেরা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভালবাসা ভালবাসা। নাটকঃ শুভ্রাসুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০), এলেবেলে, সাদা গোলাপেআগুন ও পংকজ বিভাস (১৯৮২)।রূপান্তরিত নাটকঃ প্রজাপতি নির্বন্ধ, তাইরে নাইরেনা, উন্মাদ সাক্ষাৎকার, মুক্তিমুক্তি। অনুদিত নাটকঃ দ্বার রুদ্ধ, ডক্টর ফস্টাস, এ্যান্টিগানে। প্রবন্ধঃ নাট্য বিষয়কনিবন্ধ, থিয়েটারের কথা (১ম-৫ম খন্ড), বাংলাদেশেরথিয়েটার ও অন্যান্য রচনা, স্ট্যানিসলাভস্কি ও তার অভিনয় তত্ত্ব, নাট্যকলারবিভিন্ন ইজম ও এপিক থিয়েটার, বিশ্বনাটক।

সংক্ষিপ্ত জীবনী:

জন্ম: জিয়া হায়দারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বরপাবনা জেলার দোহারপাড়াগ্রামে।

বাবা-মা: বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ। মা রহিমা খাতুন।

পড়াশুনা: জিয়া হায়দারের লেখাপড়ার শুরু তাঁর বাবারইপ্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিকস্কুলে। নাম আরিফপুর প্রাথমিক স্কুল। এখানে ক্লাস টুপর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি।পরে চলে যান পাবনা জেলা স্কুলে। সেখানে গিয়ে ক্লাসথ্রি-তে ভর্তি হন। এরপরগোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিকপাশ করেন জিয়া হায়দার। ১৯৫৬সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশকরেন। এরপর জিয়া হায়দারভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে তিনি সেখানথেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রিলাভ করেন। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইবিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরেইংল্যান্ডের বার্মিংহামবিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ারথিয়েটার' ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন: ১৯৬১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করারপর কিছুদিন কাজ করেন তখনকারজনপ্রিয় সাপ্তাহিক 'চিত্রালি'-তে। মাস্টার্সের ফলবেরুবার আগেই অধ্যাপনার চাকরিনিয়ে চলে যান তোলারাম কলেজে। যাবার সময় নিজেরচাকরিটা দিয়ে যান ছোট ভাইরশীদ হায়দারকে। নিজের লেখালেখির জগত, চাকরি আরপরিবারের ছোট ভাই-বোনদেরমানুষ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এর মাঝেকিছুদিন কাজ করেন বাংলাএকাডেমিতে। তারপরে পাকিস্তান টেলিভিশনে।টেলিভিশন ভবন তখন ছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলেযান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরহাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করারজন্য। পরে ইংল্যান্ডেরবার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'সার্টিফিকেট ইনশেক্সপিয়ার থিয়েটার' ডিগ্রিঅর্জন করেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া হায়দার যোগ দেনচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরনাট্যকলা বিভাগে। সেখান থেকেই অবসর নেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় এবংপরে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা পৃথিবী চষেবেরিয়েছেন নাটকের প্রয়োজনে।বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের নামি-দামি নাট্যজনদেরসাথে।

বিয়ে: ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন এক অধ্যাপিকাকে বিয়েকরেন। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি।কারণ অধ্যাপিকা ছিলেন সিজনাল মানসিক রোগী। সেটাবিয়ের পর ধরা পরে। কিন্তুকিছুই করার ছিল না জিয়া হায়দারের। চিকিৎসার সবরকম চেষ্টাই করেন তিনি।অবশেষে সেই সংসার ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে বিয়েরসেই তারিখ আর নিজের বিড়ম্বিতভাগ্য নিয়ে রসিকতা করে বলতেন, '১৭৫৭ সালের ২৩ জুননবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যেবিপর্যয় নেমে এসেছিল।'

মৃত্যু: শেষ জীবনে এসে আক্রান্ত হন মরণব্যাধিক্যান্সারে। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বরশেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন জিয়া হায়দার। তাঁকেচিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়ার আরিফপুর গোরস্থানে।

  www.gunijan.org.bd