Golden Bangladesh
শরীয়তপুর জেলা

[গোল্ডেন বাংলাদেশ দেশের 64 জেলার ইতিহাস সহ প্রত্যেক জেলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করতে বদ্ধ পরিকর। তাই প্রত্যেক জেলার সদস্যদের নিজ জেলার তথ্য আপলোড করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। তথ্য আপলোড কারীর নাম তথ্যসূত্রে উল্লেখ করা হবে। তাই দেরি না করে নিজ জেলার গৌরবময় ইতিহাস সংযোজন করে সাইটটিকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।]   

জেলার পটভুমি

জেলা হিসেবে ১৯৮৪ সালে আত্মপ্রকাশ করলেও এ অঞ্চলটি সৃষ্টির প্রথম হতেই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় সকল ব্যাপারেই  বিকশিত হতে থাকে। ইতিহাসের আদিকাল হতেই বিভিন্ন সামন্ত প্রভু ও রাজা দ্বারা এ অঞ্চল শাসিত হয়ে এসেছিল। আদিকালে শরীয়তপুরের এ অঞ্চল ‘বংগ’ (Vanga) রাজ্যের অধীনে ছিল। ‘বংগ’ পদ্মা নদীর দক্ষিণে বদ্বীপ অঞ্চলে বিস্তৃত তৎকালীন রাজ্যের নাম। এটি তৎকালীন ভাগীরথী এবং পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত অঞ্চল। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৮০ খৃঃ - ৪১২ খৃঃ) রাজত্বকালে প্রখ্যাত কবি কালিদাসের ‘রঘুবানসা’ গ্রন্থে তিনি এ অঞ্চলকে গঙ্গানদীর প্রবাহের দ্বীপ দেশ বলে আখ্যায়িত করেন, যার অধিবাসীগণ জীবনের সকল কর্মকান্ডে নৌকা ব্যবহার করতো। এমনকি যুদ্ধেও নৌকার ব্যবহার ছিল। এ অঞ্চলের জনসাধারণ নৌ বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। পরবর্তীতে বদ্বীপ অঞ্চল ক্রমে ক্রমে দক্ষিণে সরে যায় এবং ব্রক্ষ্মপুত্র, গঙ্গা ও অন্যান্য নদী বাহিত পলি দ্বারা এ অঞ্চল গঠিত হয়।

গুপ্ত যুগ (৪র্থ শতক থেকে ৫৪৪ খৃষ্টাব্দ)

গুপ্তবংশের রাজত্বের পূর্ববর্তী বেশ কিছু কাল এ অঞ্চলের ইতিহাস ছিল কিছুটা অষ্পষ্ট। সমুদ্রগুপ্তের (৩৪০-৩৮০ খৃঃ) আলনাবাদ সামন্তের শিলালিপি ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ের কতিপয় স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কারের ফলে এটা প্রমাণিত হয় যে, এ অঞ্চল গুপ্ত রাজবংশের অধীনস্থ এলাকা ছিল। বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া সদর হতে তিন চতুর্থাংশ মাইল দূরে গোয়াখোলা গ্রামে সোনাকান্দুরী নামক এক মাঠ খননকালে প্রাপ্ত মুদ্রায় এ সকল তথ্য আবিষ্কৃত হয়।

পরবর্তীকালে তাম্র থালা আবিষ্কার এবং তার উপর খোদাই করা মিঃ এফই পারগিটার কর্তৃক পাঠোদ্বারকৃত বক্তব্যে বুঝা যায় যে, ৬ষ্ঠ শতকে বংগের এ অঞ্চল অপর একটি রাজবংশ দ্বারা পারিচালিত হয়েছিল।মিঃ পারগিটারের মতে আনুমানিক ৫৩১ ও ৫৬৭ খৃষ্টাব্দে প্রস্ত্ততকৃত দু’টি তাম্র থালাতে লিপিবদ্ধ বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ধর্মাদিত্য নামক এক রাজা এ অঞ্চল শাসন করেন। তৃতীয় অপর একটি তাম্র থালার লিপিতে প্রাপ্ত তথ্যে রাজা গোপালচন্দ্র এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন তার আভাস পাওয়া যায়। ডঃ হর্ণলে ধর্মাদিত্যকেই সম্রাট যশোধর্মন হিসেবে বর্ণনা দেন, যিনি একজন ন্যায় ও ধার্মিক রাজা ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ধর্মাদিত্য নামে পরিচিত ছিলেন। চতুর্থ তাম্র থালা যা কোটালিপাড়ার নিকটবর্তী ধাগড়াহাটিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার শিলালিপি উদ্ধারের ফলে এটা প্রমাণিত হয় যে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ৬১৫ হতে ৬২০ খৃষ্টাব্দ সময় কালে ‘সমাচারদের’ নামক একজন স্বাধীন রাজা এ অঞ্চল শাসন করেন। মিঃ পারগিটারের সাথে সমসাময়িক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বাবু রাধা গোবিন্দও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। সমাচারদের গুপ্ত বংশের বাইরের রাজা যিনি শশাঙ্কের শাসন কালের পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেছেন।

প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩০ হতে ৬৪৩ সালের মাঝে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন যখন হর্ষবর্ধন ছিলেন ভারতের ক্ষমতার শীর্ষে। ঐ সময় তাঁর লেখাতেও জানা যায় যে, সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় এ ‘বংগ’ হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

৬৪৭ খৃষ্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ‘বংগের’ এ জেলা সহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন রাজাগণ তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। এরপর বেশ কিছুকাল এ অঞ্চল কোন কোন রাজা দ্বারা শাসিত হয়েছে তার ঐতিহাসিক তথ্যাদি অপর্যাপ্ত। কিন্তু কিছু তাম্র ফলকের বক্তব্য হতে জানা যায় যে, ‘খাদগাস’ রাজতন্ত্রের অধীনে এ অঞ্চল ৬৫০ খৃষ্টাব্দ হতে ৭০০ খ্রষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনাধীন ছিল।

শরীয়তপুর জেলার জন্য এটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে এ জেলার দুটি স্থান ইদিলপুর ও কেদারপুরে এবং বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের রামপাল অঞ্চল হতে আবিষ্কৃত তাম্র ফলকের খোদাইকৃত বক্তব্য হতে জানা যায় যে, এ অঞ্চল ‘চন্দ্রা’ নামক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসকগণ দ্বারা পরিচালিত হতো। দশম শতাব্দী হতে একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় এ অঞ্চল ঐ রাজগোষ্ঠি কর্তৃক শাসিত হয়েছিল।

১০৮০ খৃষ্টাব্দ হতে ১১৫০ খৃষ্টাব্দ সময়কাল ঢাকার বিক্রমপুর হতে ‘বর্মন’ নামক হিন্দু পরিবার এ অঞ্চলকে শাসন করেন। এদের মধ্যে বজবর্মন, জাতা বর্মন, হরি বর্মন, সামালা বর্মন ও ভোজা বর্মনের নাম উল্লেখযোগ্য। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতা’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ১০৮২ হতে ১১২৪ সাল নাগাদ রামপাল উত্তর বঙ্গ শাসন করেন। এ রামপালই ঐ সময় পূর্ব বঙ্গের শাসক একজন বর্মন রাজা, খুব সম্ভব দ্বিতীয় রাজ জাতা বর্মনকে এ অঞ্চল শাসন করার কর্তৃত্ব প্রদান করেন। এ বর্মন রাজগোষ্ঠী অর্ধ স্বাধীনভাবে এ জেলা সহ পূর্ব বঙ্গের অঞ্চল পরবর্তীতে সেন রাজবংশ কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শাসন করেন।

এরপর শুরু হয় সেন বংশের রাজত্ব। সেন বংশের তৃতীয় রাজা বিজয়সেন (খৃঃ ১০৯৭-১১৬০) শরীয়তপুর অঞ্চলের শাসক ছিলেন। বিজয়সেনই বংগের দক্ষিন পূর্বাঞ্চল হতে বর্মন শাসকদের এবং উত্তরাঞ্চল হতে ‘পাল’ রাজবংশকে উৎখাত করেন। সময়টি দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তার উত্তর সূরী বল্লাল সেন (খৃঃ ১১৬০ হতে ১১৭৯) একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন যার সুখ্যাতি সর্বত্র বিস্তৃত ছিল। বিজয়সেন ও বল্লালসেন দুজনই শিবের পূজা করতেন এবং তারা পরোপকারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বল্লালসেন আঠারো বছর রাজত্ব করেন এবং তার পর তিনি তার পুত্র লক্ষণসেনের (খৃঃ ১১৭৮ হতে ১২০৬) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাজা লক্ষণসেন ১২০৪ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। ঐ বছরই মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা আক্রমন করেন এবং সেন রাজাদের রাজধানী নদীয়া দখল করেন। এর ফলে এ বয়োবৃদ্ধ রাজা রাজধানী হতে পলায়ন করে ঢাকার বিক্রমপুরে অবসর নেন। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরগণ কয়েক যুগ এ অঞ্চলে রাজত্ব করেন। বংশধরগণের মধ্যে বিশ্বরুপসেন ১২০৬ হতে ১২২০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত সেনগণ বিনা বাধায় রাজত্ব করেছিলেন। সেনগণ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিক্রমপুর হতে তাদের শাসন ক্ষমতা হারান। ঐ সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার (কুমিল্লা-নোয়াখালী) শাসক, দেব রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দামোদর দেবের বংশধর দশরথদেব সেন রাজবংশকে উৎখাত করে শরীয়তপুর অঞ্চলসহ এ এলাকার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তখনকার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বিক্রমপুর হতে প্রদত্ত দশরথ দেবের অদ্যাবধি থালা (ক্ষমতা প্রদান পত্র) হতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দশরথদেবই হচ্ছেন জানামতে শেষ হিন্দু রাজা যিনি শরীয়তপুর এলাকা সহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাকে শাসন করেন এবং এর পরেই এ অঞ্চল মুসলমানগণের শাসনে চলে আসে।

মুগল পূর্ব যুগ (চতুর্দশ শতক হতে ১৫৭৫ সাল)

স্যার উইলিয়াম হান্টারের ঢাকা জেলা পরিসংখ্যান বিবরণী পুস্তকে প্রফেসর ব্লকম্যানের  উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ১২০৩-০৪ সালের দিকে মুসলমানগণ কর্তৃক বাংলা দখল হলেও মূলতঃ আজকের বাংলাদেশ অঞ্চলসহ পূর্বাঞ্চলের এ এলাকা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বল্লাল সেনের বংশধরগণ সম্রাট বলবনের নাতী কর্তৃক সোনারগাঁও দখল না করা পর্যন্ত শাসন করে এসেছিলেন। ১৩৩০ সালে মুহম্মদ বিন তুগলক পূর্ব বংগ দখল করেন এবং এ অঞ্চলকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করেন। লাখানুতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও। সোনারগাঁও এর গভর্ণর ছিলেন তাতার বাহরাম খান। ১৩৩৮ সালে বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তারই অস্ত্রবাহী ফখরুদ্দিন এ অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে মুবারক শাহ উপাধি নিয়ে দশ বছর শাসন করেন। ১৩৫১ সালে সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং তার পুত্র সিকান্দার শাহ কর্তৃক সমস্ত বাংলা পুনরায় একত্রিকরণ করা হয়। সোনারগাঁও ক্ষমতাসীনদের প্রধান কেন্দ্রস্থল হওয়াতে প্রায়ই এ অঞ্চল বিভিন্ন বিদ্রোহের শিকার হয়েছিল। পরবর্তীতে সিকান্দার শাহর পুত্র আজম শাহ এর উত্তরাধিকারী হন। এরপর আজম শাহর উত্তরাধীকারীগণ রাজা খান কর্তৃক উচ্ছেদ হন। ফলে পুর্বাঞ্চলীয় জেলা সমূহ রাজা খানদের দখলে চলে যায়। কিন্তু ১৪৪৫ সালের দিকে ইলিয়াস শাহের বংশধর মাহমুদ শাহ (প্রথম) কর্তৃক বাংলা আবার একীভুত হয় এবং তিনি ১৪৮৭ সাল নাগাদ দেশ শাসন করেন। এই সময় বাংলার ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে জালালাবাদ এবং ফতেহবাদ প্রদেশ গঠন করা হয়। মিঃ ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, হোসেন শাহ ১৪৯৩ হতে ১৫১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশ শাসন করেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ বাংলার মুসলিম রাজা। প্রফেসর ব্লকম্যানের মতে, হোসেন শাহ প্রথমে ফতেহবাদের (বৃহত্তর ফরিদপুর) ক্ষমতা দখল করেন এবং সেখানে তার প্রথম মুদ্রা ছাপানো হয়।

ফতেহবাদ হোসেন শাহের প্রধান শহর ছিল যা কিনা বর্তমানের ফরিদপুর শহর। জালালউদ্দিন ফতেহশাহ নামক লাকনুতি প্রদেশের শাসকের নামানুসারে ফতেহবাদ নামকরণ হয়। ফতেহবাদ ফরিদপুর, ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, দক্ষিণ শাহবাজপুর ও সন্দ্বীপ এলাকা নিয়ে গঠিত একটি সরকার বা বিভাগ ছিল।

মুগল যুগ

মুগলদের রাজত্বের সময়ে (১৫৭৬-১৭৫৭) সম্রাট আকবরের নির্দেশে ১৫৭৪ সালে মুরাদখান নামে এক সেনাপতির নের্তৃত্বে দক্ষিণ-পুর্ব বাংলা অভিযান হয়। ‘আকবর নামা’র বিবরণ অনুযায়ী ঐ সেনাপতি ফতেহবাদ (ফরিদপুর) ও বাকেরগঞ্জ দখল করেন। জনাব মুরাদ খান এরপর ফরিদপুরেই থেকে যান এবং ছয় বছর পর এখানেই তার মৃত্যু হয়। ফরিদপুর হতে ১৩ মাইল দূরে খান খানাপুরেই খুব সম্ভব তার বাসস্থান ছিল। পরবর্তীতে তাঁর ছেলেরা মুকুন্দ নামক এক হিন্দু জমিদারের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এক ভোজের নিমন্ত্রণে এসে নিহত হন।

আকবরের সময়েও মূলতঃ এ অঞ্চল মুগলদের দখলে যেতে পারেনি। এ অঞ্চল তখন প্রধানতঃ কতিপয় মুসলমান ও হিন্দু স্থানীয় প্রধানদের দ্বারা শাসিত হতো। ইংরেজ ব্যবসায়ী রালফ ফিচ, যিনি বাংলার এ অঞ্চল ভ্রমন করেন, তিনি উল্লেখ করেন যে এখানে তখন বহু বিদ্রোহী ছিল যারা আকবরের শাসনকে গ্রহণ করে নি। রালফ ফিচের মতে ‘‘এখানে অনেক নদী, দ্বীপ থাকার ফলে বিদ্রোহীগণ একস্থান হতে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াতো যার ফলে আকবরের অশ্ব বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে টিকতে পারতো না’’। এ সময় বাংলার শাসকগণই মূলতঃ বারো ভূঁইয়া নামে খ্যাত যাদের মধ্যে ঈশা খান প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন।

শরীয়তপুর -এর নড়িয়া থানার কেদারপুর নামক স্থান পূর্বে পদ্মা নদী-বিধৌত অঞ্চল ছিল। বারো ভূইঁয়াদের দু‘জন ভূইঁয়া চাদঁ রায় ও কেদার রায় এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। কেদার রায় মানসিংহের সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইহার ফলে তিনি নিহত হন। মসনদ ই আলা ঈশা খানই অন্যান্য রাজাদের প্রধান ছিলেন যার রাজত্ব ভাটি’ অর্থাৎ বক্ষ্মপুত্র, মেঘনা ও সুন্দরবনের এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

বহুবারই দিল্লীর মুগল সম্রাট আকবর বাংলার এ অঞ্চল দখল করার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তথাপি তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের বাংলার গভর্ণর ইসলাম খার (১৬০৮-১৬১৩) সময়েই মূলতঃ এ দেশে মুগল রাজত্বের ভিত্তি হয়। তখন হতেই শরীয়তপুর অঞ্চলসহ বাংলার এ এলাকা মুগলদের পতন পর্যন্তই তাদের দখলে ছিল। ইসলাম খানের পর একুশজন গভর্ণর ১৬১৩ হতে ১৭৫৭ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন। এ সময়কাল ইতিহাসে শান্তি ও সমৃদ্ধির সময় হিসেবেই পরিচিত। তবুও এ সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তা প্রাপ্ত মগ ও আরাকানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। নওয়াব শায়েস্তা খার আমলে (১৬৬৩-৭৮) ও (১৬৭৯-৮৮) মগ ও পর্তুগীজগন শায়েস্তা খানের এক অভিযানে নির্মুল হয় , যার ফলে তাদের শক্ত ঘাঁটি চট্রগ্রাম ও সন্ধীপের পতন হয়।

শায়েস্তা খাঁর সময়ে এদেশ খুবই শান্তি ও সমৃদ্ধিতে অতিবাহিত হয়। তার সময় টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেতো।শায়েস্তা খাঁর পর ১৭০৩ হতে ১৭১৬ সাল পর্যন্ত নওয়াব মুর্শিদ খান অত্যন্ত দক্ষ মুগল গভর্ণর হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি এ জেলাসহ নিকটবর্তী অঞ্চলের ভূমি প্রশাসনের পুনর্গঠন করেন এবং জায়গীর প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থ ও কর সংগ্রহের ব্যাপারে উন্নত পদক্ষেপ গ্রহন করেন। ১৭৫৭ সালের সেই পলাশির মর্মান্তিক পরিণতির পূর্ব পর্যন্ত নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা এ জেলা সহ বাংলার স্বাধীন নওয়াব হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।

বৃটিশ যুগঃ

পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার পর ১৭৬৫ সালে এ জেলা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৃষ্ট প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। শরীয়তপুর সহ ফরিদপুরের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ঢাকা নিয়াবত গঠন করা হয়। ঢাকা নিয়াবত একজন নায়েব সুবাদার বা নাইব নাজিম ঢাকাকে কেন্দ্রস্থল হিসেবে গঠন করে শাসন পরিচালনা করেন। ঢাকার নায়েব নাজিমের আওতায় প্রায় পচিঁশ হাজার বর্গমাইল অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা পরিচালিত হতো।

১৭৯৩ সাল হতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়। ঐ সময়ে হতে শরীয়তপুর জেলা অঞ্চলসহ বৃহত্তর ঢাকা, বাকেরগঞ্জ এলাকা ঢাকা জামালপুর নামে ঢাকাকে কার্য্যালয় স্থাপন করে একটি জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এ বিশাল এলাকার জেলাকে প্রয়োজনের তাগিদেই ভাগ করা হয়। ১৮০৭ সালে ঢাকা জামালপুরের জেলা সদর ফরিদপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং ঢাকা শহর ও বর্তমান ঢাকা জেলা পূর্বোক্ত ঢাকা জামালপুর জেলা হতে বাদ দেওয়া হয়। ১৮১৫ সালে ফরিদপুর জেলা একজন সহকারী কালেক্টরের অধীনে জেলা রূপে প্রকাশ পায় এবং ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত মুগল ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেকটরের আওতায় শাসন চলে। পরবর্তীতে ১৮৫৯ সালে এ ব্যবস্থার অবসান করে একজন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের ও কালেকটরের অধীনে আনা হয়। তখন ফরিদপুর জেলার আয়তন ছিল ১৩১২ বর্গমাইল।

শরীয়তপুর জেলা পূর্বে বৃহত্তর বিক্রমপুর এর অংশ ছিল। ১৮৬৯ সালে প্রশাসনের সুবিধার্থে ইহাকে বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলের জনগণের আন্দোলনের মুখে ১৮৭৩ সালেই এ অঞ্চলকে মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত করে ফরিদপুর জেলার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৮৫৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি কোন প্রতিক্রিয়া এ অঞ্চলে পড়েনি। তবে এ যুদ্ধ কোম্পানীর প্রশাসনের অবসান ঘটিয়ে গ্রেট বৃটেনের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এ উপমহাদেশকে নিয়ে আসা হয় যার ফলে শরীয়তপুর জেলাও বৃটিশ রাজ্যের সরাসরি প্রশাসনের আওতায় পড়ে।

ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সময় ১৯০৫ সালে বাংলাকে দু‘টো ভাগে বিভক্ত করা হয়। এ বিভক্ত বাংলার ইতিহাসে সুদুর প্রসারী ফল বিস্তার লাভ করে।নবগঠিত পূর্ব বঙ্গ ও আসাম রাজ্য যেখানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন সে অঞ্চলে মুসলিমগণ শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু হিন্দুগণ ইহা মেনে নিতে পারলেন না। ১৯০৬ সলে শরীয়তপুর সহ বৃহত্তর ফরিদপুরের হিন্দুগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁলেন। তারা এ বিভক্তি বিরোধী আন্দোলন সৃষ্টি করলেন এবং স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তুললেন। নতুন প্রদেশের গভর্ণর স্যার বেনফিল্ড ফুলার এ আন্দোলন দমানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তা সত্বেও আন্দোলন অধিকতর গতিশীল হলো। ফলস্বরুপ ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে এ বিভক্তি রহিত করতে হয়। ইহাই ইতিহাসে বংগভংগ আন্দোলন নামে খ্যাত।

এর পর ক্রমে ক্রমে শরীয়তপুরের অঞ্চল সহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুত্রপাত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই এ জেলায় সক্রিয় ছিলেন। এমনকি ১৯১০ হতে ১৯৩৫ সালের দিকে এ অঞ্চলের বহু বিপ্লবী সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য অংশ নেন। লোনসিংএ জন্মগ্রহণকারী বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

পাকিস্তান আমল

পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল হওয়ায় তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রাধান্য এ প্রদেশে বেশী দেখা যায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগষ্ট তৎকালীন ভারতের এ অঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে মুসলমানদের জন্য গঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান। পূর্ব বঙ্গ পরিণত হয় পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালর ১৪ ই আগষ্ট হতে ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শরীয়তপুর জেলা সহ এ প্রদেশ ছিল পাকিস্তানেরই একটি অংশ।

বাংলাদেশ আমল

ঘটনার প্রবাহে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চলের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে শোষণ আরম্ভ করে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের জনগণের সাথে সাথে শরীয়তপুরের জনগণও সেই শোষণ মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়। বহু মায়ের বুক খালি করে, বহু ভগ্নির ত্যাগের ফলে এবং লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বরুপ পায় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় ।

প্রশাসনিক সুবিধার্থে মাদারীপুরের বৃহৎ পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মহকুমা গঠনের প্রয়াস ১৯১২ সাল হতেই নেয়া হয়েছিল। এর পরে পাকিস্তান সৃষ্টিও বাংলাদেশের অভ্যুদয় নতুন প্রশাসনিক দৃষ্টি ভঙ্গি গঠন করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মাদারীপুরের পূর্বঞ্চল নিয়ে একটি নতুন মহকুমা গঠিত হবে। বিষয় নির্বাচনী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, বৃটিশ বিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে এর নাম করণ হয় শরীয়তপুর এবং এর সদর দপ্তরের জন্য পালং  থানা অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ১০ ই আগষ্ট রেডিওতে সরকার কর্তৃক মহকুমা গঠনের ঘোষণা দেয়া হয় এবং ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর এ মহকুমার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন  উপদেষ্টা জনাব আবদুল মোমেন খান। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব আমিনুর রহমান। এর পর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোঃ এরশাদ সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। ৭ই মার্চ ১৯৮৩ সালে জেলা গঠনের ঘোষণা হয়। ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ শরীয়তপুর জেলার শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী জনাব নাজিম উদ্দিন হাশিম। বর্তমান শরীয়তপুর বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। [চলবে....]

তথ্যসূত্র : http://www.shariatpur.gov.bd