Golden Bangladesh
নারায়নগঞ্জ জেলার পর্যটন অঞ্চল/দর্শনীয় স্থান সমূহ

নারায়নগঞ্জ জেলার পর্যটন অঞ্চল/দর্শনীয় স্থান সমূহ 

নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দুর্গ

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ কেল্লার স্থানটির সামনে দাঁড়াতেই বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠল। অদ্ভুত সুন্দর বিশাল এক কেল্লা। একটু একটু শিহরণও জাগল ভেতরে এই ভেবে, এ বিশাল কেল্লাটি তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের জন্য। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসক ঈশা খাঁ মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে এ জনপদকে রক্ষা করার জন্য শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদীর মিলন স্থলে কেল্লাটি নির্মাণ করেন। এখানে দিনের পর দিন না জানি কত যুদ্ধ হয়েছে। সুগঠিত এ কেল্লার নাম খিজিরপুর দুর্গ যা বর্তমান হাজীগঞ্জের দুর্গ বা কেল্লা নামে পরিচিত। ১৭০০ শতাব্দী বা তারও আগে নির্মিত এ দুর্গের সঠিক স্থপতির নাম তেমন পরিষ্কারভাবে কোথাও নেই। তবে ধারণা করা হয়, সম্ভবত সুবেদার ইসলাম খানের সঙ্গে সংঘর্ষকালীন ঈশা খাঁ এ দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিরাপত্তার জন্য মীর জুমলা অধিকাংশ সময় অবস্থান করতেন এ কেল্লায়। প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এ খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গ। চারপাশ আবদ্ধ এ কেল্লাটির দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিমে ২৫০ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে ২০০ ফুট। একটি সু-উচ্চ প্রধান ফটক রয়েছে দুর্গের পূর্বদিকে। রয়েছে কয়েকটি গোপন দরজা কেল্লার বিভিন্ন দিকে। দুর্গজুড়ে রয়েছে আÍরক্ষার জন্য মাটির উঁচু বাঁধ, যার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা সেখানে অস্ত্র রেখে মোকাবিলা করা হতো শত্রদের। দুর্গের মাঝে পুরোটাই ফাঁকা মাঠ। ধারণা করা হয়, এখানে অবস্থান নেয়া-সৈন্যরা এ মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকত। সেই সময়ে যেহেতু নদীপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম তাই নদীপথের আক্রমণ রুখতে নদীর তীরবর্তী জায়গাতেই নির্মাণ করা হয় এ দুর্গটি। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মীর জুমলা খানও অধিকাংশ সময় এ দুর্গে কাটাতেন। বিশেষ করে বর্ষার সময় তিনি এ খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গের ভার নিজ হাতে গ্রহণ করতেন। প্রতিহত করতেন নৌপথে অভিযানকারী জলদস্যুদের। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন লোক ব্যবহার করতেন এ দুর্গ নিরাপত্তার জন্য। আবার কখনও এখান থেকে পরিচালনা করেছেন যুদ্ধ। এক সময় ঢাকার নবাবেরা এটিকে ঘিরে হাফেজ মঞ্জিল নামক একটি প্রাসাদ ও উদ্যান নির্মাণ করে ছিলেন এমন জনশ্রতিও আছে। সময়ের ব্যবধানে এক সময়ের রক্ত হিম করা নাম খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গ এখন এক নীরব নিস্তব্ধ পুরাকীর্তি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ক্রমেই ক্ষয়ে পড়া এ দুর্গের অভ্যন্তর এখন ব্যবহƒত হয় গৃহপালিত পশুর চারণভূমি অথবা শিশু-কিশোরদের খেলার নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে। কেল্লার পথে খাসজমির ওপর পাট গুদামগুলো স্বাধীনতার পর থেকে অস্থায়ী লিজের কারণে সৌন্দর্য ক্ষুণœœ হতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে চলে প্রশাসনের লোক দেখানো সংস্কার যা উল্লেখ করার মতো কিছুই নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর ভবিষ্যৎ প্রজšে§র কাছে রূপকথার গল্প বলে প্রতীয়মান হবে।

আমাদের তাজমহল

সম্রাট ঈশা খাঁর রাজধানী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে দুবছর আগে যুক্ত হয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ভারতের আগ্রায় সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত তাজমহলের অনুকরণে সোনারগাঁওয়ের পেরাব নামক স্থানে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে একটি তাজমহল সদৃশ স্থাপনা। এটিকে বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় তাজমহল বলে দাবি করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা। নাম দিয়েছেন বাংলার তাজমহল। ২০০৫ সালে তাজমহল নির্মাণকাজ শুরু হয়। পঞ্চাশ টাকা প্রবেশ ফির বিনিময়ে গত ২০০৮ সালের ঈদুল আজহার দিন থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া হয় এটি। তারপর থেকে দর্শনার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন এখানে।

ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটারের দূরত্বের বাংলার তাজমহলে ঢাকা-সিলেট অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে কুমিল¬া, দাউদকান্দি অথবা সোনারগাঁওগামী যে কোনও গাড়িতে চড়ে মদনপুর বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়। সেক্ষেত্রে ভাড়া লাগে ১৫ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি বা স্কুটারে জনপ্রতি ২৫ টাকা ভাড়ায় সহজেই যাওয়া যায় তাজমহলে। অন্যভাবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে ভৈরব, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জগামী যে কোনও গাড়িতে চড়ে বরপা বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয় সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ২০ টাকা এখান থেকে সিএনজি স্কুটারে জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারেন তাজমহলে।

সোনারগাঁয়ের পানাম সিটিই আমাদের ব্যাবিলন

পানামনগর গৌরবোজ্জ্বল একটি অতি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদের নাম। এ জনপদটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভা এলাকার বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কাছে অবস্থিত। স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এক নগরীর নাম কেবলই পানাম। লোনা ইট, কালো পাথরের টেরাকোটা ধূসর স্মৃতি এখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পানাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে। নাচঘরে এখন আর নাচে না নর্তকী। বাজে না নর্তকীর পায়ের ঘুঙুর। দরবার ঘরে বসে না মানুষের মেলা। বণিক-পর্যটকদের সারি সারি ডিঙি নোঙর ফেলে না পানাম নগরীর ঘাটে। মেতে ওঠে না কেনাবেচার বর্ণিল উৎসব। ধন-দৌলতে ভরে ওঠে না খাজাঞ্চিখানা। হারিয়ে গেছে এ নগরীর জীবনের সব বর্ণাঢ্য আয়োজন, ভেঙে গেছে আলোময় জীবনের সাজানো সব খেলাঘর। থেমে গেছে প্রাণের প্রবাহ। শত শত বছরের অনাদর আর অবহেলার চিহ্ন গায়ে মেখে আজও দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ অট্টালিকাগুলো। সোনালি অতীতের সাক্ষী এসব অট্টালিকা এখনও নজর কাড়ে ভ্রমণপিয়াসী দেশী-বিদেশী পর্যটকদের।
১২৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সোনারগাঁয়ে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা হয়। ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের সময় বা স্বাধীন সুলতানি আমলে সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। তারপর পর্যায়ক্রমে শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দার শাহ, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ, শামসুদ্দীন হামজা শাহসহ আরও অনেক শাসক শাসনকার্য পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। তবে বার ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁর সময় বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সোনারগাঁ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সে সময় শাসকদের রাজকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগরী থেকে। এর পাশাপাশি রাজাদের আমির-ওমরাহদের জন্য পানাম নগরী ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছিল নিপুণ কারুকাজ খচিত পাকা ইমারতরাজি।
স্মৃতির শহর পানামকে ঘিরে আছে প্রাচীন নগর ও রাজধানীকেন্দ্রিক নস্টালজিক স্মৃতি। যে স্মৃতির বেশির ভাগই কালের করাল গ্রাসে লুপ্ত আজ। ভগ্ন ইমারতের পুরা পলেস্তরা ঘন শ্যাওলার আবরণে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি আজ ঢাকা পড়ে আছে। কারণ পানাম সম্পর্কিত লিখিত তথ্যপঞ্জির খুব অভাব। হয়তো কিছু প্রমাণপঞ্জি ছিল, সেগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে এখনও রয়ে গেছে। বিস্ময়ের বিষয়, সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে গ্রন্থ লেখা হলেও পানামনগর অবহেলিতই রয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হল, সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পানামের ইতিহাস স্থাপত্য কতটুকু গুরুত্ব বহন করে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তবে এ কথা ঠিক, পানাম ও তার আশপাশকে ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল। এসব সমৃদ্ধ জনজীবনের ধারাপর্বেই পানামে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ ও নান্দনিক জীবনযাত্রা। যে জীবনযাত্রার নান্দনিকতার কারিশমার রেশ এখনও কিছুটা টিকে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত পানামনগর এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড নিদর্শনে।
পানামে পরিলক্ষিত হয় নিপুণ কারুকাজ খচিত অসংখ্য প্রাচীন ইমারতরাজি। এখানে সরু রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাঁকশাল, দরবারকক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয় ইত্যাদি। পানাম নগরীতে দেখা যায় ৪০০ বছরে পুরনো মঠবাড়ি। এর পশ্চিমে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যকুঠি (নীলকুঠি)। রয়েছে পোদ্দারবাড়ি, কাশিনাথের বাড়ি, আর্টগ্যালারিসহ নানা প্রাচীন ভবন। তবে অধিকাংশ রয়েছে জীর্ণ, ভগ্নাবস্থায়। পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল। এ খাল পানামের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো ছুঁয়ে পুবদিকে মেনিখালি নদ হয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। খালের ওপর আদমপুর বাজারের কাছে রয়েছে মোগল আমলের সেতু (পঙ্খীরাজ সেতু)। তিনটি খিলানের ওপর নির্মিত এ সেতু ১৪ ফুট প্রশস্ত। তলদেশ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৭৩ ফুট। এ সেতুটি কে কখন নির্মাণ করেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। শেরশাহের আমলে নির্মিত সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মাইলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের কিছু অস্তিত্ব পানামে আজও দৃষ্ট হয় বলে হাল আমলে তা পাকা করা হয়েছে।
শুধু বর্ণাঢ্য অনুপম স্থাপত্য ইমারতরাজির জন্য পানাম বিখ্যাত নয়, পানামের সামগ্রিক গুরুত্ব কিন্তু অন্য কারণে। চতুর্দশ শতকে পানাম ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে বিকশিত হয়েছিল এক সমৃদ্ধ চারুকারুকলাজাত শিল্পের। যে শিল্পের কারণে পানামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এ উপমহাদেশ ছাড়িয়েও পাশ্চাত্যে। বিশ্বখ্যাত মসলিনের আদিস্থান ছিল সোনারগাঁয়। পানাম নগরী ছিল মসলিনের বিশাল আড়ং। পৃথিবীখ্যাত মসলিন শবনম, মলমুলখাস, আব-ই-রওয়া উৎপাদিত হতো পানাম নগরের আশপাশ ঘিরেই। জেমস টেলরের মতে, আড়ংয়ের তাঁতখানা সোনারগাঁয়ের পানাম নামক স্থানে ছিল এবং মসলিন শিল্প কেনাবেচার এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিল এই পানাম নামক স্থানটি। ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে এক তলা, দোতলা ও তিনতলা দালান রয়েছে পানামে। প্রায় ৫২টি ভবন রয়েছে। অবশ্য এর বেশির ভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত। সম্প্রতি এ নগরীকে সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় আনা হয়েছে।
পানামের সব ভবনের অসংখ্য কক্ষের ইট ধসে পড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে কারুকাজগুলো। তবুও কোনভাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবকাঠামোগুলো। ভুতুড়ে পানামনগরের ভবনগুলোর অন্ধকার কক্ষে একাকী দাঁড়ালে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। ভবনের অবকাঠামোগুলো মনে করিয়ে দেয় সে সময়ের বর্ণিল সব আয়োজন। প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা অজানা ইতিহাস। সোনারগাঁয়ের পানাম এখন সিটি অব ব্যাবিলন।

ঐতিহ্যের সোনারগাঁয়ে

গ্রামবাংলার প্রকৃত অস্তিত্বের রূপ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, শান্ত øিগ্ধ অপরূপ সৌন্দর্যের সন্ধানে যদি আপনি যেতে চান তো চলে আসতে পারেন প্রাচীন বাংলার রাজধানী সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের কিংবা ঈশা খাঁর সোনারগাঁয়ে। এ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই সোনারগাঁ নামের সঙ্গে পরিচিত। কেবল পরিচিতই নয়, অনেকে এসেছেন, ঘুরেছেন, দেখেছেনও সোনারগাঁকে। তদুপরি বলতে হয় সোনারগাঁয়ে রয়েছে দেখার মতো বিস্তৃত জায়গা। যেমন ধরুন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার কিংবা পাঁচ পীরের দরগার কথাই। ঢাকা থেকে কিংবা দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকেই বাসে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা নেমে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ন দেখতে সোনারগাঁকে। চৌরাস্তা থেকে পশ্চিম দিকে যে রাস্তাটি গিয়েছে রিকশা নিয়ে আগাতে থাকুন। ঐতিহ্যবাহী মোগড়াপাড়া হাইস্কুল পার হয়ে সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পাশ দিয়ে গাছপালা ঢাকা সরু পিচের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে সামনে এগুলেই সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের আমলের সোনারগাঁয়ের ইতিহাস ছিল অনেক সমৃদ্ধ। ওই রাস্তা ধরেই সামনে এগিয়ে গেলে বিখ্যাত পাঁচ পীরের মাজার। যাদের এলাকাবাসী অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্পের জাদুঘরের কথা তো সর্বজনবিদিত। জাদুঘরের বর্ণনা করে কারও সময় নষ্ট না-ই বা করলাম। জাদুঘর পেরিয়ে যেতে পারেন পানাম নগরীতে। দু
পাশে সারি সারি পুরনো ভবন। নিশ্চুপ, নিরেট শান্ত øিগ্ধ পরিবেশ। ভবনগুলোকে দেখলেই বুঝা যায় সোনারগাঁয়ের ইতিহাস কত শান-শওকতে পরিপূর্ণ ছিল। সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী গ্রামে রয়েছে বাংলার ইতিহাসের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম একটি মসজিদ। যেতে পারেন বারদীতেও। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা থেকে স্কুটার কিংবা রিকশায়। বারদীতে রয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম। হিন্দু নাগ জামিদারদের প্রাচীন ভবনগুলোও দর্শনীয়। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসুর পৈতৃক বাড়ি। শান বাঁধানো পুকুরঘাট, গাছপালা ঘেরা নৈসর্গিক দৃশ্য সম্পন্ন গ্রামবাংলার প্রকৃত রূপ।

যদি আপনি বাংলার তাজমহলকে দেখতে চান তবুও আপনাকে আসতে হবে সোনারগাঁয়েই। সোনারগাঁয়ের পেরাব গ্রামে আগ্রার তাজমহলের আদলে নবনির্মিত বাংলার তাজমহলটি অবশ্যই দেখার মতো।
সোনারগাঁয়ে দেখার মতো রয়েছে এমন অসংখ্য স্থান যেগুলোর সব বর্ণনা হয়তো করা গেল না কিন্তু ছুটির কোনও একদিনে ঘুরে বেড়ালেও সোনারগাঁকে দেখে শেষ করা যাবে না। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে আমরা আধুনিক সোনারগাঁকে দেখব দু
চোখ ভরে।

কীর্তিমানের আঙ্গিনা : নারায়ণগঞ্জের চৌধুরীপাড়া

মিজানুর রহমান মামুন
অনেকেই বলেন, ঘুরে আসুন রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের পাশের এলাকার চৌধুরীপাড়া গ্রাম থেকে। কি আছে এ চৌধুরী পাড়া গ্রামে!  কেনইবা এখানে পশ্চিমবঙ্গের(ভারতের) সাবেক মূখ্যমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির বর্ষীয়ান নেতা সময়-সুযোগ পেলেই ছুটে আসতেন। এমনকি মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি কেনইবা এখানে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন? কেনইবা ভারতের রাইটার্স বিল্ডিংয়ের রিসিপশনে গিয়ে কোনও ব্যক্তি বারদীর পরিচয় দিলে নিরাপত্তারক্ষীরা যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দোতলার মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে পৌঁছে দিত। এমন হাজারো প্রশের উত্তর জানতে ঘুরে আসুন সেই গ্রামের আলোচিত বাড়ি থেকে।
কারণ, বর্ষীয়ান নেতা জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি।  ভারতের পশ্চিবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং কিংবদন্তি নেতার শৈশব কাটে এ গ্রামে। এখানে আসলে দেখতে পাবেন এই বাড়ির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কিংবদন্তি নেতার শৈশব ও কৈশোর স্মৃতি। ২ একর ৪ শতক বাড়িটির মধ্যে রয়েছে ৮৭ বছরের পুরাতন একটি দ্বিতল ভবন। একটি পুকুর ও একটি কুয়া। বাড়ির দোতলা এ ভবনটির দেয়ালের নামফলক থেকে জানা যায় এটি ১৩২৯ বাংলা সনের ১৩ অগ্রহায়ণ তারিখে পাচু ওস্তাগারের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়। অসাধারণ এ দ্বিতীয়তলা ভবনটির নিচতলায় রয়েছে দুটি শোবার ঘর ও  একটি বৈঠকখানা। দ্বিতীয়তলায়ও রয়েছে দুটি  শোবার ঘর। রয়েছে একটি বেলকুনি। ভবনের ছাদ থেকে এক অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। দক্ষিণে তাকালে প্রমত্তা মেঘনা নদী আর চারদিকে কেবলই সবুজের সমারোহ। মূলত এ বাড়িটির মালিক ছিলেন জ্যোতি বসুর নানা শরৎচন্দ্র দাস ও স্ত্রী খিরদা সুন্দরী। শরৎচন্দ্র দাস  ও স্ত্রী খিরদা সুন্দরীর একমাত্র মেয়ে হেমলতা বসুকে স্থানীয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ডা. নিশিকান্ত বসু বিয়ে করার সুবাদে এ বাড়ির মালিক হন। ডা. নিশিকান্ত ও হেমলতা বসুর তৃতীয় সন্তান জ্যোতি বসু। শৈশবের কিছুটা সময় তিনি তার পৈতৃক বাড়ি বারদীতে কাটিয়ে ছিলেন।
বৃক্ষের প্রতি তার অনেক আগ্রহ ছিল। তার হাতে রোপণ করা বিভিন্ন ফলদ ও ভেষজের মধ্যে আমগাছ, তালগাছ ও শিমুল গাছগুলো তার স্মৃতিকে তাড়া করছে। কলকাতায় পড়ালেখার ফাঁকে ছুটে আসতেন এখানে। জ্যোতি বসু যখনই বারদীতে আসতেন তখন তার সেবাযতেœর কাজ করেছিলেন আয়াতুন নেছা নামে একজন । পাশাপাশি আয়াতুন নেছার স্বামী ফকির মাহমুদ কলকাতা শহরে অবস্থিত জ্যোতি বসুর পিতা ডা. নিশিকান্ত বসুর একটি তেলের কারখানায় চাকরি করতেন। সে সুবাদে এ মুসলিম পরিবারটির সঙ্গে জ্যোতি বসুর পরিবারের একটি আÍার সম্পর্ক তৈরি হয়। জ্যোতি বসুর পরিবার কলকাতায়ই বেশি থাকতেন। তাই বাড়িটির দেখাশোনার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে ফকির মাহমুদের পরিবারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সে থেকে ফকির মাহমুদের পরিবার জ্যোতি বসুর এ বাড়িটিতে বসবাস করে আসছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জ্যোতি বসুর পিতামহের এ বাড়ির ভবনটি ছাড়া অন্যসব জমিদারদের পাকা দালান প্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তার স্মৃতিমাখা বারদী চৌধুরী পাড়া  গ্রামের সেই পৈতৃক বাড়িটি দেখতে আসেন। এসময় তার সঙ্গী ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী মিজানুর রহমান এবং জ্যোতি বসুর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ (কমলা বসু) ও ছেলে চন্দন বসু । জ্যোতি বসু সর্বশেষ বারদীতে তার পৈতৃক বাড়িতে আসেন ১৯৯৭ সালে তখন তার সফরসঙ্গী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উপ-মূখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাস গুপ্ত।  জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় দুবারই তার পৈতৃক ভিটে বারদীতে এসে বাল্যবন্ধুদের খোঁজখবর নিয়েছিলেন এবং ভবনের দ্বিতীয় তলার শয়নকক্ষে দীর্ঘক্ষণ বসে অতীতের স্মৃতিচারণ করেন। এ ছাড়াও ২০১০ সালের শুরুর দিকে জ্যোতি বসু তার পৈতৃক বাড়িতে আসার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেননি। সরকার ইতিমধ্যে জ্যোতি বসুর এ প্রাণপ্রিয় স্মৃতিমাখা বাড়িটিকে সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার একটি আধুনিকমানের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়িতে আসতে হলে চলে আসতে হবে বারদীর চৌধুরী পাড়া গ্রামে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর থেকে বাসে করে ১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে বারদী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম এলাকায় আসবেন। আশ্রম এলাকা থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত বাড়িটিতে হেঁটেও যেতে পারেন অথবা রিকশায় করে ৫ ভাড়া নেবে।

চলুন ১০০ বছর পেছনে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায়

জয়নাল আবেদীন জয়
প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি কালের গহ্বরে ঢাকা পড়লেও এর নিদর্শন চিরকাল অম্লান হয়ে থাকে। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িটি তেমনই একটি স্মৃতিচিহ্ন। এ বাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা ও আজকের এই কোলাহলপূর্ণ জন বসতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ জমিদার বাড়ি। ছায়া নিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়ির  যে কোন ভ্রমণপিপাসুর মন কাড়ে।

গোড়াপত্তনের ইতিহাস : রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকায় ৫২ বিঘা জমির উপর এই প্রকাণ্ড জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জমিদার বাবু রাম রতন ব্যানার্জী তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জমিদারদের ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ। তিনিই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। রাম রতন ব্যানার্জীর পুত্র পিতাম্বর ব্যানার্জী এবং তৎপুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জী শাহজাদপুরের জমিদারি ক্রয় করে জমিদারি বর্ধন করেন। কথিত আছে, জমিদারি ক্রয় সূত্রে প্রতাপ ব্যানার্জীর সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকা নাথ ঠাকুরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র  ব্যানার্জীর পৈতৃক এজমালি পুরনো বাড়ি ত্যাগ করে আলোচ্য এ প্রাসাদের  পেছনের অংশ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সম্মুখ অংশের একতলা ভবন নির্মাণ ও সেখানে ২টি পুকুর খনন করার পর হƒদরোগে মারা যান। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গ্রাজুয়েট। বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জীর দুই সুযোগ্য পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৯০৯ সালে প্রাসাদটির দোতলার কাজ সম্পন্ন করেন। এ অঞ্চলে জগদীশ চন্দ্র  ব্যানার্জীর নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি দুবার দিল্লির কাউন্সিল অব স্টেটের পূর্ববঙ্গ থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রজা সাধারণের কল্যাণসাধনের জন্য স্থাপন করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুকুর । ১৯৪৭ সালে তৎকালীন জমিদার জগদীশ চন্দ্র  ব্যানার্জী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। ফলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর প্রতাপশালী সেই রাজবাড়িটি বিরান হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র : ট্যুরিস্ট গাইড 24