Golden Bangladesh
কোথায় যাচ্ছি আমরা

কোথায় যাচ্ছি আমরা

চেয়ারম্যান, মোহাম্মদী গ্রুপ এবং সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, সার্ক চেম্বার।

আনিসুল হক 

আনিসুল হক 

আনিসুল হক 

আনিসুল হক 

আনিসুল হক 

এ কোন বাংলাদেশের নাগরিক আমরা? চিরচেনা, অথচ আজ অচেনা এক দেশ। অসীম সম্ভাবনার এক দেশ, ধ্বংসের সীমানায় ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছে যার।

'৫২-তে মায়ের ভাষার অধিকারের আন্দোলন, '৬৯-এ মায়ের 'স্বাধীনতা' আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। '৭১-এ 'বাংলা' মা স্বাধীন হলো। তারপর তো শুধু স্বপ্ন দেখার কথা, আর স্বপ্ন পূরণের কথা। মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন, কৃষকের স্বপ্ন, ছাত্রের স্বপ্ন, মজদুরের স্বপ্ন, বোনের, ভাইয়ের, বীরাঙ্গনা মায়ের স্বপ্ন। বাঁচার স্বপ্ন, গড়ার স্বপ্ন।

৪২ বছরের এই লম্বা পরিক্রমায় আজ কোথায় আমরা? চারদিকে এ কী দৃশ্য! মনে হচ্ছে, এ দেশের রাজাদের রাজার নীতি-বাঁচার নীতি, প্রজাদের মারার নীতিতে রূপ নিচ্ছে। দুই যুগ ধরে প্রতি পাঁচ বছরে এ দেশের ইতিহাস বদলায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে, কখনো বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ঘোষণা করা যায় না, কখনো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। আমরা সিলেটের, নোয়াখালীর, চট্টগ্রামের অথবা রাজশাহীর- আমাদের সবার এক চেহারা, এক ভাষা, একই রক্ত। সেই আমাদের সবাইকে পাঁচ বছর বাঙালি, আরেক পাঁচ বছর বাংলাদেশি হওয়ার বিতর্কের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কখনো শাসক শোষক হন, কখনো শোষক সময়ানুক্রমে গণতন্ত্রের দোসর হওয়ার অপপ্রয়াস চালান। আবার এরই সঙ্গে ইতিহাসে কার অবস্থান কোথায়, কতটুকু প্রাপ্য, তা নির্ধারিত হয় কে ক্ষমতায় আছেন তার ওপর। মনে করে দেখুন ১৯৮৯ সালে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে সারা দেশ আন্দোলনের এক পতাকার নিচে সমবেত হয়ে স্বৈরাচারী শাসককে বিদায় করলেন। তারপর '৯৬ থেকে সেই স্বৈরশাসককে নিয়েই রশি টানাটানি। তিনি প্রায়ই ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি। আর আজ এ একই দেশে 'গণতন্ত্র'-কে বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় ছোট্ট শিশুর আঙ্গুল পুড়ছে, হাত পুড়ছে, কত গীতার শরীর পুড়ছে, পুড়ছে জীবন, পুড়ছে দেশ। বাংলাদেশে আজ সাধারণ মানুষের লাশের মিছিল। বাতাসে পোড়া মানুষের গন্ধ। বাবার খোঁজে পাগলপ্রায় ওয়াহিদ, পোশাককর্মী রবিন, সদরঘাটের রিয়াজ অথবা স্বামীগর্বে গর্বিতা, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া গীতা_ এরা অন্য কোনো গ্রহের মানুষ নন, ভিন দেশের বাসিন্দা নন। যে পুলিশটি আমাদের বাঁচানোর জন্য প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা নিজের জীবনকে বাজি রাখছেন, ক্যামেরার পেছনে যে তরুণী রিপোর্টার গুলির মধ্যে ছুটছেন, সকালে যার স্বামী কাজে যাচ্ছেন_ তারা কেউ জানেন না আবার তারা ঘরে ফিরবেন, নাকি আগুনে ঝলসে অথবা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে হাসপাতালের করিডরে লাশ হয়ে পড়ে থাকবেন।

অন্তরালে থাকা যাদের অঙ্গুলি হেলনে এ দেশের মানুষের প্রাণ যায়, তাদের মতোই এ মানুষগুলোও পালাক্রমে কখনো বাঙালি, কখনো বাংলাদেশি। অভিন্ন এক দেশের ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। মানুষ বাঁচানোর আন্দোলন আজ মানুষ পোড়ানোর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। গণতন্ত্র বাঁচানোর আন্দোলন আজ গণতন্ত্র হরণের পথ করে দিচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে যারা শপথ নেন, তাদের কার্যক্রম আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে পারছে না। পাশের ঘরের প্রতিবেশী আজ সন্ত্রাসী হয়ে গেছেন। অর্থনীতি গড়া যাদের দায়িত্ব তারা আজ অর্থনীতি ধ্বংসের কারিগর। এত সবের জন্য দায়ী কারা? ভয়ে প্রায়ই তাদের নাম, পরিচয় বলতে পারি না। তবে এতটুকু জানি, তারা সাধারণ ছাত্র নন, কর্মজীবী মানুষ নন, শ্রমিক নন, ব্যবসায়ী নন- যাদের বিশ্বাস করে আমরা বছরের পর বছর 'ভোট' আমানত তুলে দিই, গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে দুই যুগ ধরে প্রতি পাঁচ বছর পর যারা আমাদের কাছে 'এক দিন' হাত জোড় করে দাঁড়ান। এক দিনের জন্যই গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকশিত হয়। বড় নেতা হন, সংসদ সদস্য হন, কিন্তু পার্লামেন্টে যান না, শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনেন, বেতনও নেন (ব্যবসা ইত্যাদির কথা না-ই বা বললাম) কিন্তু পাঁচ বছর আর জবাবদিহিতার ধার ধারেন না। দায়ী প্রাথমিকভাবে এরাই। কোথায় যাচ্ছি আমরা? কৃষক তার ফসল বেচতে পারছে না, দিনমজুর কাজ করতে পারছে না, দোকানদার দোকান খুলতে পারছে না, স্কুলের ছাত্র পরীক্ষা দিতে পারছে না, ফ্যাক্টরি চলে না, আমদানি-রপ্তানি হয় না, শ্রমিকের বেতন দেয়া যাচ্ছে না, প্রতিদিন কাজ করে খাওয়া মানুষটি কাল কী করে খাবে জানে না। প্রতি রাতে যখন টিভি দেখি, প্রতি সকালে খবরের কাগজ পড়ি বিস্মিত হই, কোন দেশে আছি আমি- বাংলাদেশে না সোমালিয়ায়? ইরাকে না লিবিয়ায়?

স্বাধীনতার বিরোধীরা আজ 'স্বাধীন'- এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখিনি। আমরা, সাধারণ মানুষেরও আশা আছে, স্বপ্ন আছে। আমার সন্তান এ দেশে থাকতে চায়, শ্রমিক কাজের নিশ্চয়তা চায়, বেতন চায়, ছাত্র স্কুলে যেতে চায়, মালি ফুল ফোটাতে চায়, মা তার সন্তানের ঘরে ফেরার প্রহর গোনেন। সম্মানিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আপনাদের সবার চারপাশে কালো কাচের দেয়াল উঠে গেছে। আপনারা আর সাধারণ মানুষের চোখ দেখতে পান না, চোখের ভাষা পড়তে পারেন না। হয়তো বা পড়তে চানও না। গণভোট নিয়ে দেখুন, আস্থার আর বিশ্বাসের কোন স্তরে আপনাদের স্থান। প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের সীমানায় ১৬ কোটি বাঙালি/বাংলাদেশি আজ অবরুদ্ধ। আপনাদের উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা বা সাহস আমার নেই। নতুন কোনো কথা শোনাতে পারব না। ক্ষমা চেয়ে তবু বলছি- আমাদের গভীর শঙ্কা, সবাই মিলে (বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা) এ সহিংসতার বীজ এখনই যদি সমূলে উপড়ে না ফেলেন তাহলে এর দহনে শীঘ্রই এ দেশ আফ্রিকার বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের রূপ নেবে। টিভি বা খবরের কাগজ দেখে তা-ই মনে হয়। জ্ঞানী লোকেরা বলেন, 'ইতিহাস বারবার ফিরে আসে'। যদি রাজনীতিবিদরা এই বিষাক্ত বর্তমানকে এখনই সমাধিস্থ না করেন, তাহলে এই বর্তমান আর অতীত হবে না। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক স্থান ১৯৭৩-৭৪ এর তৎকালীন ভিন্ন আদর্শের রাজনীতির জন্ম দেওয়া সহিংসতার ঘানি এখনো টানছে। ১৬ কোটি মানুষকে বলি দেবেন না। সে বলির ছুুরি যে কখন একসময় আপনাদের অগোচরে বুমেরাং হয়ে যাবে, বুঝতেই পারবেন না। সহিংসতার এ আগুনে কে কখন পুড়বে, তা নির্ধারণ করার জাদুর চেরাগ আপনার/আমার কারও হাতে নেই। আজ দেখুন, কেমন এক উপমহাদেশীয় অস্থিরতায় ভুগছি আমরা। ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবসে, আমাদের মা-বোনের ওপর '৭১-এ সম্ভ্রমহানির নিষ্পেষণ চালিয়েছিল যারা, ৩০ লাখ বাংলাদেশির রক্তে বাংলার মাটি রক্তাক্ত করেছিল যারা সেই তারাই, সেই পাকিস্তানিরাই, তাদের পার্লামেন্টে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীকে নিজেদের দোসর বানিয়ে তার বিষয়ে বিল পাস করে। রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দেশবাসী সমস্বরে এর প্রতিবাদ করুন। মাননীয় দুই নেত্রী, সংগ্রাম-কষ্ট, দুঃখ-যাতনার লম্বা রাস্তা পেরিয়ে আপনারা আজ স্ব স্ব স্থানে উপনীত। তার ওপর দুজনই নারী, দুজনই 'মা'। ত্যাগের মহিমার উদাহরণে 'মা'র তো তুলনা হয় না। তবুও নিজেই নিজকে হাজারো প্রশ্ন করি- দুই 'মা'র হাতে আমাদের ১৬ কোটি সন্তানের জীবনের এই অনিশ্চয়তা কেন? আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের জন্য, দেশের জন্য, স্বার্থহীন নিরন্তর ভালোবাসার যে কথা প্রতিদিন আপনারা উচ্চারণ করেন, প্রমাণের এখনই উত্তম সময়। মাস্তানমুক্ত, সহিংসতামুক্ত, ঈর্ষামুক্ত সহিষ্ণু একটি বাংলাদেশ দিন। ইতিহাস কাউকেই বারবার 'কীর্তিমান' হওয়ার সুযোগ দেয় না।